Top Header
Author BartaLive.com
তারিখ: ২৫ জুন ২০২৫, ০১:১১ অপরাহ্ণ

প্রেমের মোহে ঝরে গেল প্রাণ, উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও প্রশাসন

News Image

বাঞ্ছারামপুরে আত্মহত্যা ও পারিবারিক অশান্তির পেছনে প্রেম—চিন্তিত অভিভাবক ও প্রশাসন।
একটা সময় ছিল, যখন স্কুলের পথে হেঁটে যাওয়া মানে ছিল বইয়ের কথা ভাবা। এখন সেই পথেই কিছু তরুণ-তরুণী হারিয়ে ফেলছে জীবনের মূল লক্ষ্য।

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবা‌ড়িয়া‌র বাঞ্ছারামপুরে প্রেমঘটিত কারণে দুই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা নাড়া দিয়েছে পুরো এলাকাকে। তারা শুধু নিজের জীবনই শেষ করেনি, দুটো পরিবার ডুবিয়েছে চরম বেদনায়।

শুধু এই দুটি ঘটনা নয়—এমন ভালোবাসার মোহে পড়ে শিক্ষাজীবন নষ্ট, পরিবারে কলহ, আর সম্মানহানি ঘটছে নিয়মিত।
প্রেমের শুরু হয় ফেসবুক থেকে, ফোনে দীর্ঘ কথা, দেখা-সাক্ষাৎ, তারপর একসময় ভাঙন। আর সেই ভাঙন নিয়ে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে নীরব বিদায়ের পথ। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসন, শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
তারা মনে করছেন, এখনই যদি সচেতন না হওয়া যায়, তবে সামনে আরও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।


ওসির মন্তব্য: “একটি মোহ কীভাবে প্রাণঘাতী হতে পারে, আমরা চোখের সামনে দেখছি”

এ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি বাঞ্ছারামপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন,
“আমরা সম্প্রতি এমন ঘটনা দেখেছি, যেখানে একটি অসম বয়সী প্রেমের সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত দুই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যায় গড়িয়েছে। কিন্তু আত্মহত্যা শুধু দুটি তরুণ প্রাণের মৃত্যু নয়—এটা দুটি পরিবারকে চিরদিনের জন্য ভেঙে দিয়েছে, তছনছ করে দিয়েছে বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়দের জীবন। একটি সম্পর্কের মোহের পরিণতি কীভাবে ভয়াবহ হতে পারে, সেটাই এখন আমরা চোখের সামনে দেখছি। ছোট বয়সে ছেলে-মেয়েরা যা করে, সেটাকে আমরা প্রেম বলি না—এটা একধরনের আবেগের ভুল ব্যাখ্যা, একপ্রকার মোহ। এই মোহে পড়ে তারা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়—কারো সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া, শিক্ষাজীবন নষ্ট করে ফেলা, পরিবার ত্যাগ, আর কখনো কখনো আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া—এসব এখন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

তিনি আরও বলেন,
“গত কয়েক বছরে আমি নিজের চোখে দেখেছি—এই ধরণের সম্পর্কের কারণে কত পরিবার ধ্বংস হয়েছে। একটি ব্যর্থ প্রেম কীভাবে একজন মায়ের বুক খালি করে দেয়, একজন বাবাকে সমাজের চোখে ছোট করে দেয়, সেটা বোঝা যায় কেবল কাছ থেকে দেখলে। এই মুহূর্তে যদি আমরা সতর্ক না হই, তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ সামাজিক সংকটের মুখে পড়তে হবে।”

“সামাজিক মাধ্যম, খোলা প্রযুক্তি ও অভিভাবকদের উদাসীনতা একসঙ্গে মিলে তরুণদের বিপথে ঠেলে দিচ্ছে। তাই এখনই সময় পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজকে এক হয়ে এগিয়ে আসার—না হলে একটি প্রেমের ভুল বোঝাবুঝিতে আমরা হারিয়ে ফেলব হাজারো সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।”


ইউএনও ফেরদৌস আরা: “স্বপ্নের সুরক্ষায় দায়বদ্ধ হতে হবে”

উপ‌জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফেরদৌস আরা বলেন,
“আমরা আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে যতটা স্বপ্ন দেখি, ততটাই দায়বদ্ধ হতে হবে সেই স্বপ্নের সুরক্ষায়ও।”

আজকের তরুণরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু প্রেমের নামে একধরনের বেপরোয়া মোহ এবং আবেগের বশবর্তী হয়ে তারা নিজেরাই নিজের ভবিষ্যৎকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নয়—এটি এখন একটি বড় সামাজিক সংকট।

আমরা দেখেছি, অপ্রাপ্তবয়স্ক বয়সে গড়ে ওঠা সম্পর্কের পরিণতিতে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে, পরিবার ভাঙছে, আর সমাজে তৈরি হচ্ছে হতাশা ও অস্থিরতা। এর পেছনে রয়েছে পারিবারিক উদাসীনতা, সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়।


সমাধানের পথে তিনটি স্তম্ভ: পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের তিনটি স্তম্ভ—পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ—একযোগে কাজ করতে হবে।

প্রথমত, অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান থাকবে—সন্তানদের সময় দিন, তাদের মনোযোগ দিয়ে শোনুন। আপনার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, কী নিয়ে ভাবছে—এসব জানতে বন্ধুর মতো পাশে থাকুন।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেবল বইয়ের শিক্ষা নয়—মানসিক স্বাস্থ্য, নৈতিকতা ও জীবনের লক্ষ্য নিয়ে আলাপ হওয়া প্রয়োজন। এজন্য আমরা শিগগিরই বাঞ্ছারামপুর উপজেলার প্রতিটি স্কুলে ‘কাউন্সেলিং ক্যাম্পেইন’ চালু করতে যাচ্ছি। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মনোচিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত পরামর্শদাতারা কথা বলবেন, তাদের মানসিক চাপ, আবেগ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হবে।

তৃতীয়ত, সমাজকে আরও সচেতন হতে হবে। সামাজিকভাবে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে তরুণরা ভুল পথে নয়—নিজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাবে। আমরা যদি এখনই সতর্ক না হই, তবে একটি ভুল সম্পর্কে ডুবে যাবে অনেক সম্ভাবনাময় জীবন।

কিন্তু সম্মিলিত চেষ্টায়, সচেতনতা আর ভালোবাসায় গড়ে উঠতে পারে একটি সুস্থ, নৈতিক ও স্বপ্নময় প্রজন্ম।

Watermark