Top Header
Author BartaLive.com
তারিখ: ২ জুলাই ২০২৫, ০২:১৩ অপরাহ্ণ

কে হবেন পরবর্তী দলাই লামা – দুইজন দলাই লামা হতে পারেন?

News Image

দলাই লামা নিশ্চিত করেছেন, তার মৃত্যুর পর একজন উত্তরসূরি নির্বাচিত হবেন, যিনি তিব্বতীয় বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব বহন করবেন। তবে এই নির্বাচন কেবল ধর্মীয় নয়, এটি একটি স্পষ্ট ভূরাজনৈতিক ইস্যু – যেখানে বেইজিং, ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লি প্রত্যেকে তাদের স্বার্থ বজায় রাখতে এই নির্বাচনে প্রভাব রাখতে চাইবে।

৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে তিব্বত সরকারের নির্বাসিত পার্লামেন্ট, ধর্মগুরু ও সারা বিশ্বের তিব্বতি বৌদ্ধদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দলাই লামা বলেন, “দলাই লামা প্রতিষ্ঠানটি চলতে থাকবে।”

তবে প্রশ্ন উঠছে, উত্তরসূরি কীভাবে নির্বাচিত হবেন? এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন – দুইজন দলাই লামা কি সম্ভব?


কীভাবে দলাই লামা নির্বাচন হয়?

দলাই লামাকে  “করুণার বোধিসত্ত্ব”–এর পুনর্জন্ম হিসেবে ধরা হয়। এক জন দলাই লামার মৃত্যুর পর উচ্চপদস্থ লামারা বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ও দৈব চিহ্ন বিশ্লেষণ করে তার পরবর্তী পুনর্জন্ম খুঁজে বের করেন।

লাহামো লাতসো নামে তিব্বতের একটি পবিত্র হ্রদে দর্শন লাভ, দাহকালে ধোঁয়ার দিক নির্ণয়, মৃত্যুর আগের দৃষ্টিপাতের দিক ইত্যাদির ভিত্তিতে সম্ভাব্য প্রার্থী নির্বাচন করা হয়। প্রার্থীদের শিশু বয়সেই শনাক্ত করা হয় এবং তাদের আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

বর্তমান দলাই লামা (চতুর্দশ) বলেছেন, ভবিষ্যতের দলাই লামা নারীও হতে পারেন।

তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দলাই লামা – যিনি করুণাময় বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের অবতার হিসেবে পরিচিত – তার মৃত্যুর পর একজন উত্তরসূরির থাকার কথা ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এই ঘোষণার সাথে সাথেই প্রশ্ন উঠেছে, পরবর্তী দলাই লামাকে কে বেছে নেবে? এবং, ভবিষ্যতে কি দুটি দলাই লামা দেখা যাবে?

বৌদ্ধ ধর্মমতে, প্রতিটি দলাই লামা হচ্ছেন আগের দলের পুনর্জন্ম। ইতিহাস অনুযায়ী, এক দালাই লামার মৃত্যুর পর বৌদ্ধ সাধকরা আত্মার নতুন আশ্রয় খুঁজে বেড়ান, সাধারণত একজন অল্পবয়সী ছেলের মাঝে। দীর্ঘ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে প্রাসাদে এনে বৌদ্ধ দর্শন, ধর্মশিক্ষা ও নেতৃত্বের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

বর্তমান দলাই লামা কে?

বর্তমানে চতুর্দশ দলাই লামা তেনজিং গিয়াৎসো, ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং দুই বছর বয়সে পুনর্জন্ম হিসেবে স্বীকৃতি পান। তার বাসভবন ছিল তিব্বতের লাসা শহরে অবস্থিত ঐতিহাসিক পোতালা প্রাসাদে। কিন্তু ১৯৫৯ সালে চীনের বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তিনি গোপনে দেশত্যাগ করে ভারতের ধর্মশালায় আশ্রয় নেন। সেখানে “লিটল লাসা” নামে পরিচিত মেকলিয়ডগঞ্জ শহরেই তিনি বর্তমানে বসবাস করছেন।

দলাই লামার ঘোষণা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

৯০তম জন্মবার্ষিকীর আয়োজনে তিনি বলেন, “দলাই লামা প্রতিষ্ঠানটি চলমান থাকবে” – একটি বক্তব্য যা শুধু ধর্মীয় নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি আরো বলেন, নতুন দলাই লামা “মুক্ত বিশ্বে” জন্ম নেবেন – যা স্পষ্টভাবে চীন-নিয়ন্ত্রিত তিব্বতের বাইরে কাউকে বোঝায়। অনেকের মতে, এ কথায় ভারতের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে।

তিনি পূর্বে বলেছেন যে একজন নারীও ভবিষ্যতের দলাই লামা হতে পারেন। আবার ২০১১ ও ২০১৪ সালে তিনি জানিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে আর কোনো দলাই লামা নাও থাকতে পারে। এমনকি বলেছিলেন, “কোনো বোকা দলাই লামা যদি আসে, তবে তার চেয়ে এই ঐতিহ্যের অবসানই শ্রেয়।”

চীনের দাবি ও দ্বৈত দলাই লামার আশঙ্কা

চীন শুরু থেকেই দলাই লামাকে “বিচ্ছিন্নতাবাদী” বলে দাবি করে এবং ২০০৭ সালের এক আইনে বলে যে সব বৌদ্ধ গুরুদের পুনর্জন্ম অনুমোদিত হতে হবে বেইজিংয়ের মাধ্যমে। তারা ঐতিহাসিক “গোল্ডেন আর্ন” পদ্ধতির কথা বলে, যেখানে প্রার্থীদের নাম লটারির মতো তুলে নেওয়া হয়।

চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা তিব্বতে ১৯৯৫ সালে একই ঘটনা ঘটেছিল, যখন দলাই লামা একজন ৬ বছরের শিশুকে প্যানচেন লামা ঘোষণা করেন। চীন সঙ্গে সঙ্গে সেই শিশুকে গোপনে সরিয়ে নেয় এবং আজও তার কোনো খোঁজ নেই। তারা নিজস্ব একজন প্যানচেন লামা নিযুক্ত করে, যিনি তিব্বতিদের কাছে গ্রহণযোগ্য নন।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই অভিজ্ঞতা থেকেই দলাই লামা চান না যে ভবিষ্যতের কোনো দলাই লামা চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল থেকে আসুক। কারণ চীন পুনরায় তাকে অপহরণ করতে পারে।

আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও দুই দলাই লামা?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৪তম দলাই লামার মৃত্যুর পর দুইজন দলাই লামা আবির্ভূত হতে পারেন—একজন বেইজিং-সমর্থিত, আরেকজন ভারতের আশ্রয়ে তিব্বতি সম্প্রদায়ের বাছাইকৃত। এটি ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে তেমন প্রভাব ফেলবে না, তবে তিব্বতের জনগণের উপর ভয়াবহ চাপ তৈরি করবে।

ভারতের জন্য এই বিষয়টি শুধু ধর্মীয় নয়—চীনের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত কার্ড। ভারতের হিমালয় সীমান্তে তিব্বতি শরণার্থীরা একধরনের “সফট পাওয়ার” হিসেবে কাজ করে।

যুক্তরাষ্ট্রও Tibetan Policy and Support Act (TPSA), 2020 আইনের মাধ্যমে দলাই লামার নিজস্বভাবে উত্তরসূরি নির্ধারণের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই আইনে চীনা হস্তক্ষেপকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

দলাই লামা নিজেই ২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,

“দুই দলাই লামা দেখা গেলে – একজন চীনে আরেকজন স্বাধীন বিশ্বে – মানুষ চীনের দলাই লামাকে বিশ্বাস করবে না।”

এই সংকট শুধু ধর্মের নয়, এটি এক বহুমাত্রিক কূটনৈতিক যুদ্ধ, যেখানে পুনর্জন্ম হয়ে উঠেছে জাতীয়তা, ভূখণ্ড ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রতীক।

তিব্বত কি আবার সেই হারানো আত্মিক নেতৃত্ব ফিরে পাবে, নাকি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে? উত্তর সময়ই বলবে।


তথ্যসূত্র:
– আল জাজিরা, বিবিসি, দলাই লামার বই Voice for the Voiceless, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস দলিল, তিব্বত গবেষক ডিব্যেশ আনন্দ ও রবার্ট বারনেটের বিশ্লেষণ

Watermark