গোপালগঞ্জ সহিংসতা নিয়ে পুলিশের বিস্তারিত প্রতিবেদন
জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মরণ এবং সে সময়কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ১ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত দেশব্যাপী এক মাসব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে, যার শিরোনাম ছিল “রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য জুলাই পদযাত্রা”। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই সকাল ১১টায় গোপালগঞ্জ পৌরসভা মুক্তমঞ্চে “গোপালগঞ্জ অভিমুখে পদযাত্রা” শিরোনামে একটি গণসমাবেশ আয়োজনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এই সমাবেশে যোগদানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা— আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, দক্ষিণ অঞ্চলের প্রধান সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, উত্তর অঞ্চলের প্রধান সংগঠক সারজিস আলম, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব সামান্তা শারমিন ও তাসনিম জারা, সিনিয়র প্রধান সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, এবং আরিফুল ডারিয়া — বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকার সার্কিট হাউস থেকে গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
সকাল থেকেই সমাবেশস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন মোতায়েন ছিল। তবে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটের দিকে গোপালগঞ্জ সদরের উলপুর এলাকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায় এবং তাদের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনায় এক পুলিশ ইন্সপেক্টর ও দুই পুলিশ সদস্য আহত হন।
সকাল ১১টার দিকে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কের কংসুর বাসস্ট্যান্ডে গোপালগঞ্জ পৌর শাখার নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ওমর ফারুক খান রিপনের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন কর্মী গাছ ফেলে এবং কাঠে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে। গোপালগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসারের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছালে সেটিও ভাঙচুর করা হয় এবং সড়ক অবরোধ অব্যাহত থাকে।
১১টা ৩০ মিনিটে কোটালীপাড়া থানাধীন আবদার হাট এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা, কোটালীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম ডারিয়ার নেতৃত্বে, একটি মিছিল বের করে কোটালীপাড়া-পয়সারহাট সড়ক গাছ ফেলে ও বাঁশ দিয়ে অবরোধ করে। এই অবরোধে আনুমানিক ২৮০০ থেকে ৩০০০ কর্মী অংশগ্রহণ করে। একইভাবে, ১১টা ৪০ মিনিটে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠি বাজার এলাকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের পৌর শাখার নেতা মামুনের নেতৃত্বে ২০০–৩০০ কর্মী দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়ক অবরোধ করে।
বিকাল ১টা ৪০ মিনিটে, সমাবেশস্থলে এনসিপি নেতারা পৌঁছানোর আগেই “জয় বাংলা” স্লোগান দিতে দিতে ৫০–৬০ জন হামলাকারী দেশীয় অস্ত্র, ঢাল এবং ককটেলসহ মঞ্চে আক্রমণ চালায়। তারা ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে ও চেয়ার ভাঙচুর করে। তবুও বিকাল ২টা ০১ মিনিটে নাহিদ ইসলাম ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে ওঠেন এবং সমাবেশ শুরু করেন।
এর কিছুক্ষণ পর, ২টা ১৫ মিনিটে গোপালগঞ্জ সদরের সাতপাড়া বাজার এলাকায় আরও দুটি ককটেল বিস্ফোরিত হয় এবং দুটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা কাঠের গুঁড়ি দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে এবং বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগায়।
সমাবেশ শেষ হয় ২টা ৫০ মিনিটে। এরপর নাহিদ ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতারা নিরাপত্তা প্রহরায় স্থান ত্যাগ করেন এবং পরবর্তী গন্তব্য মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তবে বিকাল ৩টার দিকে গোপালগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনালের কাছে তাদের বহর স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মীরা আটকায়। তারা দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালায়।
পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপেও পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায়, হামলাকারীরা ইট-পাটকেল ছোড়ে এবং পুলিশ, সেনাবাহিনী ও এনসিপির সদস্যদের ওপর ধারালো ও ভোতা অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। তারা সরকারি স্থাপনাও আক্রমণ করে, যার মধ্যে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারও ছিল। এই হামলায় ৪ জন নিহত হয় এবং ৫০ জনের বেশি আহত হন, যাদের মধ্যে ৪৫ জন পুলিশ সদস্য ও কয়েকজন সাংবাদিকও রয়েছেন।
সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী এনসিপি নেতাদের নিরাপদে গোপালগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যান। বিকাল ৪টা ৫৮ মিনিটে যৌথ বাহিনীর সহায়তায় তারা বাগেরহাট হয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
রাত ৭টা ৩০ মিনিটে একদল উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি গোপালগঞ্জ জেলা হাসপাতাল থেকে নিহতদের মরদেহ জোরপূর্বক নিয়ে যায় এবং চিকিৎসকদের ময়নাতদন্তে বাধা দেয়।
এ পর্যন্ত ২০ জন সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে। গোপালগঞ্জে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ১৫০৭ জন পুলিশ সদস্য, সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে। বর্তমানে গোপালগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও শান্ত রয়েছে।