ছোটবেলা থেকেই আমি চিন্তিত থাকতাম—আমি কি যথেষ্ট ভালো করছি? হংকং শহরে বড় হওয়া মানেই প্রতিযোগিতার মাঝে বড় হওয়া। সবাই চাইতো সেরা হতে, আমিও চাইতাম। কিন্তু এই চাওয়া নিয়ে অনেক মানসিক চাপও ছিল।
২০১২ সালে আমি প্রথম মানসিক প্রশান্তির জন্য ‘মাইন্ডফুলনেস’ চর্চা শুরু করি। এতে আমার আবেগ সামলানো অনেক সহজ হয়, চিন্তা-ভাবনাও পরিষ্কার হয়। আমি একজন শিক্ষাবিষয়ক মনোবিজ্ঞানী হিসেবে নানা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হই, আর তাই মনে করি, বিশেষ করে হংকংয়ের মতো ব্যস্ত শহরে স্কুলগুলোতে এই মাইন্ডফুলনেস চর্চা খুবই জরুরি।
এই ভাবনা থেকেই আমি ‘স্পেস-আউট’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। এটি মূলত এক প্রতিযোগিতা যেখানে কিছু না করাই নিয়ম। গত বছর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিযোগিতাটির বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহী হই। প্রতিযোগিতার প্রতিষ্ঠাতা, কোরিয়ান শিল্পী উপসইয়াং বলেছেন, আমাদের সমাজে সব সময় কিছু না কিছু করে যাওয়ার চাপ আছে, তাই একেবারে কিছু না করাটাও এক ধরনের মানসিক প্রশান্তি।
২০১৪ সালে সিওলে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতাটি ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত, এটি একটি পারফরম্যান্স-আর্ট—যেখানে প্রতিযোগীরা ৯০ মিনিট ধরে স্থির বসে থাকে, কোনো কথা বলা, ঘুমানো বা মোবাইল দেখা একেবারে নিষিদ্ধ।
গত অক্টোবর আমি হংকংয়ে অংশ নিই এক অনুষ্ঠানে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে শহরের একটি ব্যস্ত শপিং মলের মাঝে খোলা জায়গায় আয়োজনটি হয়। প্রায় ১০০ জন প্রতিযোগী, সবাই নিজের করে নেওয়া একটি ইয়োগা ম্যাটে বসে। আশেপাশে দর্শকদের কথাবার্তা, গুঞ্জন চলছিল।
প্রতিযোগিতা শুরুর আগে কিছু স্ট্রেচিং করানো হয়, এরপর শুরু হয় ৯০ মিনিটের নীরবতা। প্রতি ১৫ মিনিট পরপর বিচারকরা এসে হৃদস্পন্দনের হার মাপেন, যা প্রতিযোগীদের নার্ভাস করে তোলে। আমিও টেনশন অনুভব করছিলাম, কিন্তু নিজেকে বলছিলাম—এই অস্বস্তিকে মেনে নেওয়ার এটাই সুযোগ।
আমার চিন্তা তখন ঘুরছিল পরিবারের কথা, গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ, পাশে চলা ফ্যানের শব্দ—সবকিছু নিয়ে। কিন্তু আমি সেসব চিন্তাকে শুধু পর্যবেক্ষণ করছিলাম—যেন আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ, আসছে আর যাচ্ছে।
আমি নিজের নিঃশ্বাস, শরীরের অনুভূতি, চারপাশের পরিবেশের ক্ষুদ্র পরিবর্তনগুলোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলাম। আসলে, যদিও এটিকে ‘স্পেস-আউট’ প্রতিযোগিতা বলা হয়, আমি ছিলাম পুরোপুরি মনোযোগী, সচেতন—এক ধরনের মাইন্ডফুলনেস অনুশীলনই করছিলাম।
৩০ মিনিট পর হঠাৎ মনে হলো, আমাদের তো দর্শকরাও বিচার করছে। তাই ভাবলাম, ‘স্পেস-আউট’ হওয়া দেখতে কেমন লাগে। আমি আমার চশমা একটু নিচে নামিয়ে দিলাম, তারপর প্রায় এক ঘণ্টা সেভাবেই বসে থাকলাম।
যখন ঘোষণা এলো যে সময় শেষ, তখন আমার মনে হচ্ছিল—আমি আরও বসে থাকতে পারতাম। আমার প্রতিদিনকার জীবন খুবই ব্যস্ত: চাকরি, পড়াশোনা, দুই সন্তান (একজন ১১ আরেকজন ৯ বছর বয়সী)—এই ৯০ মিনিট যেন ছিল এক বিলাসিতা।
আমি চমকে যাই যখন ঘোষণা দেওয়া হয়—আমি বিজয়ী! অনেকের কাছে ৯০ মিনিট চুপচাপ বসে থাকা দুঃস্বপ্ন, কিন্তু আমার কাছে ছিল এক প্রশান্তির মুহূর্ত।
আমার বিশ্বাস, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কিছুক্ষণ থেমে যাওয়া খুব জরুরি। অনেক সমাজে থেমে যাওয়াকে অলসতা মনে করা হয়। কিন্তু এই ৯০ মিনিট আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সব সময় উৎপাদনশীল হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি নয়।
আমি যে ট্রফি পেয়েছি, তা রডিনের বিখ্যাত ‘The Thinker’ মূর্তির অনুকরণে বানানো। সেটি এখন আমার বসার ঘরে রাখা, আমাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়—নিজের জন্য একটু সময় নেওয়া, কিছু না করাও হতে পারে জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
এই লেখাটি দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত হয়, লেখক Denis Kwan Hong-Wang, যিনি হংকং-এর একজন শিক্ষামূলক মনোবিজ্ঞানী।