বাঙালি মুসলিমদের পুশ-ইন: যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে ভারত, উদ্বেগ জানাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে শত শত বাঙালি মুসলিমকে অবৈধ অভিবাসী দাবি করে কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো (পুশ-ইন) অব্যাহত রেখেছে ভারত সরকার। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এক প্রতিবেদনে বিষয়টি প্রকাশ করে বলেছে, ভারতের এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইনি প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন।
২৩ জুলাই (বুধবার) প্রকাশিত প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, ২০২৫ সালের মে মাস থেকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ‘অবৈধ অভিবাসী’ চিহ্নিত করার অভিযানের অংশ হিসেবে এ অভিযান জোরদার করেছে। অথচ পুশ-ইনের শিকার অনেক ব্যক্তিই ভারতের বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন রাজ্যগুলোর নাগরিক এবং তারা দীর্ঘদিন ধরেই ভারতে বসবাস করছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক অ্যালেইন পিয়ারসন বলেন, “ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার স্থানীয় বাঙালি মুসলিম—যাদের অনেকে ভারতীয় নাগরিক—তাদের জোরপূর্বক বহিষ্কার করে বৈষম্যকেই উসকে দিচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “সরকারের অবৈধ অভিবাসন ঠেকানোর যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তারা কোনো প্রকার বৈধ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে না। বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মৌলিক মানদণ্ড অবজ্ঞা করছে।”
২০২৫ সালের জুনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৮ জন ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকার নেয়। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশে পুশ-ইনের শিকার হয়ে পরে ভারতে ফিরেছেন। কারও কারও পরিবারের সদস্য এখনও নিখোঁজ।
আসামের ৫১ বছর বয়সী এক প্রমাণিত ভারতীয় নাগরিক ও স্কুলশিক্ষক খাইরুল ইসলাম জানান, ২৬ মে তাকে এবং আরও ১৪ জনকে বিএসএফ জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায়। তিনি বলেন, “আমি বাংলাদেশে প্রবেশে অস্বীকৃতি জানালে বিএসএফ কর্মকর্তারা আমাকে মারধর করে এবং আমার মাথার ওপর চারবার রাবার বুলেট ছোড়ে।” দুই সপ্তাহ পর তিনি ভারতে ফিরে আসেন।
এইচআরডব্লিউ আরও জানায়, পুশ-ইনের শিকাররা অধিকাংশই দরিদ্র মুসলিম অভিবাসী শ্রমিক। আসাম, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওডিশা ও রাজস্থান রাজ্য থেকে তাদের আটক করে সীমান্তরক্ষীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অনেককে মারধর ও হুমকি দিয়ে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এমনকি বন্দুকের মুখে সীমান্ত পার করানো হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, ৭ মে থেকে ১৫ জুনের মধ্যে ভারত থেকে ১,৫০০-র বেশি মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুকে পুশ-ইন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ জন রোহিঙ্গাও রয়েছে।
এ নিয়ে ৮ মে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত সরকারকে পাঠানো এক চিঠিতে পুশ-ইন প্রক্রিয়াকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছে এবং জানিয়েছে, বাংলাদেশ শুধু নিশ্চিত বাংলাদেশি নাগরিকদেরই গ্রহণ করবে, তাও নির্ধারিত বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, মে মাসে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজ্য সরকারগুলোকে ৩০ দিনের মধ্যে অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত করে তাদের আটকের জন্য প্রতিটি জেলায় হোল্ডিং সেন্টার গড়ার নির্দেশ দেয়। এরপর থেকেই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলিমদের আটক ও বহিষ্কারের হার বেড়ে যায়।
বিজেপির উচ্চপদস্থ নেতারা বারবার বাংলাদেশ থেকে আগত ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটি ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রচারে মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তু করেছেন। এতে হিন্দু ভোটারদের মনপসন্দ বার্তা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এর শিকার হচ্ছেন দরিদ্র, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, কাউকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া আটক ও বহিষ্কার করা মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন। সংস্থাটি বলেছে, ভারত সরকারের উচিত—
এছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হুমকি, সহিংসতা ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছে সংস্থাটি। তারা বলেছে, শিশু, নারী, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
এইচআরডব্লিউ পরিচালক অ্যালেইন পিয়ারসন বলেন, “ভারত সরকার যাদের অবৈধ অভিবাসী বলে দমন করছে, তারা অনেকেই নিরপরাধ এবং নিজেদের দেশের নাগরিক। বিজেপি সরকার রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য মানবিক দায়িত্ব ও ঐতিহ্য জলাঞ্জলি দিচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতের অভিবাসননীতি যেন মানবিকতার পরিপন্থী না হয়, সে জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।”