জাপানের রাজধানী টোকিওর অভিজাত গিনজা এলাকার সড়কে বিদেশিদের আচরণে বিরক্ত ৩৮ বছর বয়সী হেয়ারড্রেসার ইউতা কাতো। তিনি বলেন, “এটা বৈষম্যের বিষয় নয়, কিন্তু ওরা কেন টের পায় না?” — তাঁর অভিযোগ, বিদেশিরা সামাজিক শিষ্টাচার না মেনে রাস্তা আটকে রাখে কিংবা ট্রেনে উচ্চ শব্দে ভিডিও চালিয়ে অন্যান্য যাত্রীদের বিরক্ত করে।
এই বিরক্তিই তাকে ঠেলে দিয়েছে ডানপন্থী রাজনৈতিক দল সানসেইতো-র দিকে, যারা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উচ্চকক্ষ নির্বাচনে ১৪টি আসনে বিজয়ী হয়ে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। বিদেশিদের আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দলটি তরুণ ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, বিশেষ করে পুরুষ ভোটারদের মধ্যে।
সানসেইতো তাদের রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দিতে ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়াকে দক্ষভাবে ব্যবহার করেছে। দলটির “জাপান ফার্স্ট” বার্তাটি অনলাইনে ব্যাপক আলোচিত হয়। যদিও জাপানে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমনে বড় শহরগুলোতে বিদেশিদের উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
দলটি নির্দিষ্ট কোনো অভিবাসী গোষ্ঠীকে সরাসরি লক্ষ্য না করলেও, টোকিওভিত্তিক গবেষক রোমিও মারকানটোনি বলেন, সানসেইতো এমন এক আবেগের ওপর ভর করে চলেছে, যেখানে ‘খারাপ আচরণকারী পর্যটক’ থেকে শুরু করে চীনের ‘গোপন প্রভাব’ নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পর্যন্ত রয়েছে।
কাতো বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন—জাপানে বসবাসকারী চীনারা, যারা সবচেয়ে বড় বিদেশি গোষ্ঠী, ধীরে ধীরে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। অনলাইনেও চীনবিরোধী অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য খুব সাধারণ হয়ে উঠেছে। দলটির নেতা সোহেই কামিয়া ও অন্য নেতারাও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ তুলেছেন, চীনারা জাপানের জমি ও সম্পদ কিনে নিচ্ছে। দলটির ওয়েবসাইটে “বিদেশি শক্তির নীরব আগ্রাসন ঠেকানো” একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
যদিও সানসেইতো এই অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তারা জেনোফোবিক (বিদেশিবিদ্বেষী) নয়, তবুও দলের উত্থান জাপানের মূলধারার রাজনীতিতে বিদেশিবিরোধী বক্তব্যের প্রভাব বাড়িয়ে তুলেছে।
এনএইচকে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে দলটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, যেখানে পুরুষদের অংশগ্রহণ নারীদের তুলনায় বেশি। অন্যদিকে দেশটির ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), যারা এবারের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে, তাদের সমর্থন মূলত ৭০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
সানসেইতো তরুণ ভোটারদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে এলডিপির চেয়ে অনেক এগিয়ে। দলটির ইউটিউব চ্যানেলের অনুসারী এলডিপির তুলনায় তিন গুণ বেশি এবং ব্যবহারকারীদের সম্পৃক্ততা (engagement) অনেক বেশি। আসাহি সংবাদপত্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের ভিডিওতে প্রতিক্রিয়া, মন্তব্য ও শেয়ারের হার অন্যান্য দলের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
কান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক জেফরি হল বলেন, “এরা ইউটিউবের দল।” হল জাপানে ডানপন্থী রাজনীতির ওপর একটি বইও লিখেছেন।
সানসেইতো ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারির সময় উদ্ভব হয়, তখন তারা টিকা নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ায়। পরবর্তীতে অভিবাসনবিরোধী অবস্থান এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংকটে পড়া পরিবারগুলোর পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলটি নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সক্ষম হয়। দলটি আরও দাবি করে, তারা জাপানের শান্তিপূর্ণ সংবিধান বাতিল করতে চায় এবং সম্রাটের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়—এ ধরনের দাবিকে অনেক সময় ‘ফ্রিঞ্জ’ বা প্রান্তিক রাজনীতির আওতায় ধরা হয়, যা সাধারণত শহরজুড়ে সামরিক সংগীত বাজানো কালো ট্রাকের মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
তবে সাধারণ মানুষের কাছে এতদিন এসব বিষয় অবজ্ঞার চোখে দেখা হলেও, সানসেইতো এখন ইউরোপের আফডি (AfD, জার্মানি) বা ব্রিটেনের রিফর্ম ইউকের মতো ডানপন্থী দলগুলোর সাফল্যের পথ অনুসরণ করতে চায়।
গত সোমবার টোকিওর ব্যস্ত শিনবাশি ট্রেন স্টেশনের বাইরে সানসেইতোর নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের এক সমাবেশে করতালি দিয়ে স্বাগত জানান সমর্থকেরা। ৪৭ বছর বয়সী গৃহিণী এরিকো হারাদা, যিনি ‘সামুরাই স্পিরিট’ লেখা হেডব্যান্ড পরে কিমোনোতে উপস্থিত ছিলেন, বলেন, “এবার প্রথমবারের মতো আমি ভোট দিয়েছি। তারা কাজ করে দেখাবে।”
তবে দলটির উত্থান বিরূপ প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করেছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, তারা জেনোফোবিয়াকে স্বাভাবিক করে তুলছে। সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছিলেন প্রতিবাদকারী মিরোকো কাতো, ৪২ বছর বয়সী এক হাইকু কবি। তিনি বলেন, “মানুষ এখন মিথ্যার ফাঁদে পড়ছে, নিজেদের অর্থনৈতিক কষ্ট বা রাজনৈতিক হতাশা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আমরা বলতে এসেছি—আমরা নজর রাখছি!”