আজ থেকে এক বছর আগে, ২০২৪ সালের এই দিনে ফ্যাসিস্ট শাসক হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সেই সঙ্গে রাহুমুক্ত হয় বাংলাদেশ। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য এই দিনটি পরিণত হয় বিজয়ের এবং আনন্দের প্রতীক হিসেবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই দিনটিকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ ঘোষণা করেছে, যা এখন থেকে প্রতি বছর সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হবে।
গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, একুশ শতকের বাংলাদেশে পলাতক স্বৈরাচার এক ভয়ঙ্কর শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল। গুম, খুন, অপহরণ, মামলা ও নির্যাতন ছিল সেখানে নিত্যদিনের ঘটনা। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে চলা আন্দোলনে বিএনপিসহ ভিন্নমতের লাখো-কোটি নেতাকর্মীকে নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। হাজারো মিথ্যা মামলার কারণে মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে, অনেকের পারিবারিক জীবন ধ্বংস হয়েছে।
এই সময়ে দেশে নির্মিত হয়েছিল শত শত গোপন বন্দীখানা, যেগুলো পরিচিত ছিল ‘আয়নাঘর’ নামে। সেসব অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর মানুষকে বন্দী রাখা হতো। অনেকে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন। বিএনপির সাবেক এমপি ইলিয়াস আলী এবং কমিশনার চৌধুরী আলমের আজও কোনো খোঁজ মেলেনি।
বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছিল। সংবিধান লঙ্ঘন করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়, যেখানে বই-কলমের বদলে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় রাজনৈতিক সহিংসতার অস্ত্র লাঠি, বৈঠা, হাতুড়ি।
অর্থনীতির বেহাল অবস্থাও তুলে ধরেন তারেক রহমান। ব্যাংকগুলো দেউলিয়া, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, দুর্নীতি, লুটপাট সবই ছিল সেই সময়ের চিত্র। ব্যক্তি কেন্দ্রিক শাসনের মাধ্যমে গোটা দেশকে অস্থির করে তোলা হয়েছিল।
তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। দেশের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, গার্মেন্টস কর্মী, এমনকি গৃহিণী ও শিশু পর্যন্ত সবাই রাজপথে নেমে আসে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে। এই গণঅভ্যুত্থান দমন করতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়। শহীদ হন শিশু আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধসহ আরও অনেকে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শহীদ হন দেড় হাজারের বেশি মানুষ, আহত হন অন্তত ৩০ হাজার। শত শত মানুষ অঙ্গহানি কিংবা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে পঙ্গু বা অন্ধ হয়ে গেছেন।
তারেক রহমান বলেন, ১৯৭১ সাল ছিল স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ, আর ২০২৪ ছিল স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ। দুই সময়েই লাখো মানুষ শহীদ হয়েছেন। শহীদদের এই আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা যে ঋণে আবদ্ধ হয়েছি, তা পরিশোধ করতে হবে গণতান্ত্রিক, মানবিক ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে।
তিনি আরও বলেন, একটি জবাবদিহিমূলক, জনদায়িত্বসম্পন্ন রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠাই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রথম পদক্ষেপ। আর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই লক্ষ্যে কাজ করছে।
বিগত দেড় দশকের শাসনকাল একমাত্র স্বাধীনতার পরবর্তী তিন-সাড়ে তিন বছরের ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের আর কোনো সময়ের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তাই যারা এখনকার সরকারের ত্রুটি খুঁজে পলাতক ফ্যাসিস্টের শাসনকে আড়াল করতে চান, তাদের সতর্ক করে তিনি বলেন নাৎসি জার্মানির মতোই ফ্যাসিস্ট শাসনের গৌরব করার কিছু নেই। ডাকাতের দান যেমন তাকে গ্রহণযোগ্য করে না, তেমনি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দুঃশাসনও কিছু চ্যারিটি দিয়ে ধোয়ামোছা যায় না।
৫ আগস্ট যা ঘটেছে, তা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাস নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল। গণভবন ফেলে পালিয়েছে শাসক, সংসদ ফেলে পালিয়েছে সাংসদ, আদালত ছেড়েছেন প্রধান বিচারপতি, মসজিদ ছেড়েছেন প্রধান খতিব, মন্ত্রীরা মন্ত্রিপরিষদ ছেড়েছেন, আর তাদের সহযোগীরা গা ঢাকা দিয়েছেন। অথচ এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও পলাতকদের মনে অনুশোচনা নেই।
তারেক রহমান বলেন, শহীদের রক্তস্নাত রাজপথে এক অবিচ্ছেদ্য জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। এই বাংলাদেশে আর কখনো ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে না, গণতন্ত্র হত্যা করা যাবে না। দলীয় আদর্শে ভিন্নমত থাকবে, সেটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে এই ভিন্নমত কখনোই যেন চরমপন্থা, উগ্রবাদ বা ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের সুযোগ না করে দেয় এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্রকামী জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে।