প্রায় আড়াই বছর পর প্রবাস জীবন শেষ করে স্বপ্নের মতো দেশে ফিরছিলেন মো. বাহার উদ্দিন। দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে পরিবারের সবার মধ্যে আনন্দ আর উত্তেজনা। ফেসবুকে বাহার লিখেছিলেন, “স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার” একটি আবেগঘন বার্তা, যা ছিল ভালোবাসার টানে ঘরে ফেরার এক মিষ্টি ঘোষণা।
তাঁর এই প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে পরিবারে চলছিল নানা প্রস্তুতি। প্রিয়জনকে বরণ করতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন স্ত্রী কবিতা, ছোট মেয়ে মীম, মা মোরশিদা বেগমসহ পরিবারের আরও সদস্যরা। কিন্তু কারও কল্পনাতেই ছিল না, এই আনন্দময় যাত্রা এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডিতে রূপ নেবে।
বুধবার ভোরে বাহার উদ্দিনকে নিয়ে ফেরার পথে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের জগদীশপুর এলাকায় একটি মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের খালে পড়ে যায়। মুহূর্তেই আনন্দভরা যাত্রাটি পরিণত হয় কান্নায়, আর চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস।
ঘটনার সময় গাড়িতে মোট ১৩ জন যাত্রী ছিলেন। ঘুমন্ত চালক হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারালে গাড়িটি সোজা গিয়ে পড়ে খালের পানিতে। বাহার উদ্দিন, তার বাবা আব্দুর রহীমসহ মোট পাঁচজন জানালার কাঁচ ভেঙে কোনোমতে বেরিয়ে আসতে পারলেও, তার মা, স্ত্রী, শিশু কন্যাসহ সাতজন প্রাণ হারান। তারা ছিলেন গাড়ির ভেতরে আটকে। প্রায় দুই ঘণ্টা পানির নিচে আটকা পড়ে থাকার পর ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার করা হয় সাতটি নিথর দেহ।
নিহতরা হলেন বাহারের স্ত্রী কবিতা (২৪), কন্যা মীম (২), মা মোরশিদা বেগম (৫৫), নানি ফয়েজ্জুনেছা (৮০), ভাবি লাবনী বেগম (৩০), ভাতিজি রেশমি আক্তার (৮) এবং লামিয়া আক্তার (৯)।
এ দুর্ঘটনার পর বাহার উদ্দিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসের নিচে ভেসে উঠেছে অজস্র শোকবার্তা। কেউ একজন সেই স্ট্যাটাসের নিচে একটি ছবি পোস্ট করেছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে একটি সাদা ব্যাগে মোড়ানো মরদেহের দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন বাহার উদ্দিন। চোখে মুখে অসহায়তা, যন্ত্রণায় জর্জরিত এক নিঃশব্দ চিৎকার।
ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মাইক্রোবাসটি দ্রুতগতিতে চলছিল এবং খালের ধার ঘেঁষেই হঠাৎ করে পানিতে পড়ে যায়। দুর্ঘটনার পর চালক পানি থেকে উঠে পালিয়ে যায়। চন্দ্রগঞ্জ হাইওয়ে থানার ওসি মো. মোবারক হোসেন ভূঁইয়া জানান, চালক ঘুমিয়ে পড়ায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে এবং মৃতদেহগুলো হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
প্রবাসী বাহার উদ্দিনের বাবা আব্দুর রহীম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “ড্রাইভার বারবার ঘুমাচ্ছিল। আমরা বারবার বলেছি, গাড়ি থামাও, একটু ঘুমাও। কিন্তু সে বলেছে, সমস্যা নেই। এক সময় ঘুমে ঢলে পড়ে আবার ঝাঁকুনিতে জেগে উঠছিল। শেষ পর্যন্ত সে ঘুমের মধ্যেই গাড়িটি খালে ফেলে দেয়।”
তিনি বলেন, “গাড়িতে ছিলাম আমি, আমার ছেলে, ছেলের বউ, আমার মা, স্ত্রী ও তিন নাতনি। তাদের মধ্যে আমরা ৪ জন বেঁচে গেলাম, বাকি সবাই মারা গেল। একেবারে পরিবারটাই শেষ হয়ে গেল।”
এই মর্মান্তিক ঘটনায় পুরো এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। প্রতিবেশীরা কাঁদছেন, আত্মীয়স্বজন বাকরুদ্ধ। একটি পরিবারের এতজন সদস্যকে একসাথে হারানোর ব্যথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।