লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চৌপালী গ্রামের কাসারি বাড়িতে আজ সকালটা নেমে এসেছে নিস্তব্ধ এক শোকে। বাড়ির উঠানে পাশাপাশি সাতটি লাশ ঘিরে চলছে স্বজনদের আহাজারি। চারদিকে কান্নার রোল, কিন্তু বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধ আবদুর রহিম নিশ্চুপ। কোনো শব্দ নেই তার মুখে, কেবল চোখ বেয়ে নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। একসঙ্গে স্ত্রী, শাশুড়ি, দুই পুত্রবধূ ও তিন নাতনিকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ তিনি।
ঘটনার শুরু মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে। ওমানপ্রবাসী ছেলে আবদুল বাহার তিন বছর পর দেশে ফিরছিলেন। তাকে বরণ করতে আবদুর রহিমের পরিবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যায়। স্ত্রী খুরশিদা বেগম, মা ফয়জুন নেসা, পুত্রবধূ কবিতা ও লাবনী, নাতনিরা রেশমি, লামিয়া ও ছোট্ট মীম সবাই ছিলেন সেই গাড়িতে।
বাহারকে নিয়ে পরিবারটি লক্ষ্মীপুরে ফিরছিল। কিন্তু আজ বুধবার ভোরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার জগদীশপুর এলাকায় চৌমুহনী-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কে চালকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইক্রোবাসটি পাশের খালে পড়ে যায়।
গাড়িটি পড়ে যায় গভীর খালে। মুহূর্তেই পানির নিচে তলিয়ে যায়। বাহার জানান, গাড়িটা পড়ে গিয়েছিল ঠিক নৌকার মতো ভেসে। বলছিলাম ড্রাইভারকে দরজার লক খুলে দাও, তাহলে সবাই সাঁতার কেটে বের হতে পারতাম। কিন্তু সে লক না খুলে নিজেই জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে আমরা কয়েকজন জানালা ভেঙে বের হই, কিন্তু মা-মেয়ে-বউরা আর পারল না।
এই দুর্ঘটনায় নিহত সাতজনের মধ্যে ছিলেন বাহারের স্ত্রী কবিতা বেগম (৩০), মা খুরশিদা বেগম (৫৫), শাশুড়ি ফয়জুন নেসা (৮০), পুত্রবধূ লাবনী বেগম (৩০), নাতনি রেশমি (১০), লামিয়া (৯) ও মীম (২)। বাড়ির উঠানে সাদা কাপড়ে মোড়ানো সাতটি নিথর দেহ, আর পাশে আহাজারি করতে থাকা স্বজনদের মুখে একটিই প্রশ্ন “এমনটা কেন হলো?”
আবদুর রহিমকে বিছানা থেকে কোলে করে এনে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি যেন শুনতেই পাচ্ছেন না কিছু। স্তব্ধ, পাথর হয়ে যাওয়া মানুষটি কেবল শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিলেন সামনে।
প্রবাসী ছেলে বাহার তখন উঠানে হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদছিলেন। বলছিলেন, আমি দেশে ফিরছিলাম সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতে, অথচ চোখের সামনে সবাইকে হারালাম। কারে ছেড়ে কারে বাঁচামু, বুঝি নাই… আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচব?
বাহার বলেন, গাড়ির চালক ঘুমঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। কুমিল্লা পার হওয়ার সময় একবার দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল। তখনও সবাই তাকে ঘুমাতে বলেছিল। কিন্তু সে শোনেনি। শেষমেশ সেই ঘুমেই ঘটে গেল অপ্রত্যাশিত এক ট্র্যাজেডি।
এলাকাবাসী জানায়, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রবাস ফেরত ছেলে বাহারকে বরণ করতে ঢাকায় গিয়েছিল পুরো পরিবার। সেই প্রত্যাবর্তন আনন্দ নয়, শোক নিয়ে ফিরল গ্রামে।
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই কাসারি বাড়িতে ভিড় জমায় শত শত মানুষ। লাশগুলো বাড়িতে আনার পর আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
উত্তর জয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান বলেন, একই পরিবারের সাতজন নারী ও শিশুর মৃত্যুতে পুরো গ্রাম শোকে স্তব্ধ। আমরা এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য আগে কখনও দেখিনি।
নোয়াখালী ফায়ার সার্ভিসের চৌমুহনী স্টেশনের কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক জানান, মাইক্রোবাসটিতে চালকসহ ১১ জন ছিলেন। এর মধ্যে চালক ও তিনজন কোনোভাবে বেরিয়ে আসতে পারলেও পেছনের আসনে থাকা সাতজনই মারা যান। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, চালকের ঘুমের কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।